কবে থেকে যেন তানির চোখে একটাই রঙ ঘুরে বেড়াচ্ছে — হলুদ।
শুকনো পাতার মতো নরম, সূর্যের আলোয় ঝলমলে, আর মনভোলানো এক রঙ। মাঝে মাঝে ওর খুব ইচ্ছে করে একদম হলুদ হয়ে যাই— যেমন স্বপ্নরা হয়ে যায় আলোতে ভাসা ভোরে।
চোখ বন্ধ করলে তানি দেখতে পায়— শাদা কার্নিশ ঘেরা একটা জানলা, হালকা বাতাস, পর্দা দুলছে, আর জানলার ধারে সে নিজেই বসে আছে। গায়ে হালকা হলুদ শাড়ি, চুলগুলো বাতাসে নাচছে। মনে হয় চুলগুলো যেন বলছে— “এই নাটাই কেটে দাও, আমরা আরও উড়বো!”
হুট করেই একদিন ছোট ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে— শাড়ির দোকান ঘুরতে।
দোকানের আলো, রঙ, কাপড়ের গন্ধ— সব যেন একরকম জাদু। কিন্তু তানি হতাশ,
“হলুদ কেউ চেনে না নাকি? এগুলোও কি হলুদ!”
ঠিক তখনই চোখ আটকে গেল একটা শাড়িতে।
নরম আলোয় ভেসে থাকা সেই কাপড়ে হাত ছুঁইতেই মনে হলো — এটাই সেই স্বপ্নটা, যা সস্তা হতে পারে না।
“এই শাড়িটা খুলে দেখানো যাবে?”
সেলসগার্ল মিষ্টি হাসল — “জ্বী আপু, আসুন, শুধু আঁচলটা পরিয়ে দেই।”
আয়নায় নিজেকে দেখে তানি অবাক — ও যেন অন্য কেউ!
একটা মৃদু হাসি এল ঠোঁটে, কিন্তু চোখে একটু দুঃখও।
“দাম কত?”
দাম শুনে বুক কেঁপে উঠল না, কিন্তু মন কেমন যেন হল। টাকা আছে, কিন্তু ও জানে — সব ইচ্ছে কেনা যায় না। তাই শাড়িটা নেয় না।
বাসায় ফিরে এল দু’জন। কিন্তু মাথার ভেতর ঘুরছে সেই একটাই শাড়ি।
রাত জেগে ভাবে — “না, কিনব না! শুধু একটা শাড়ির জন্য এত টাকা কেন?”
তারপরও মন বলে — “মোহ না, এটা ভালোবাসা!”
অবশেষে তানি প্রার্থনা করল,
“ঈশ্বর, ওই শাড়িটা কেউ যেন নিয়ে যায়! আমি যেন আর না পারি ওটা কিনতে!”
কিন্তু ইচ্ছে? তাকে কে আটকায়!
কিছুদিন পর মা’কে নিয়ে ফের গেল সেই দোকানে। বুকের মধ্যে অজানা কাঁপুনি — “থাকবে তো শাড়িটা?”
চোখ ঘুরে ঘুরে খুঁজে, খুঁজে… কিন্তু কোথাও নেই।
সেলসগার্ল চেনা মুখে হেসে বলল — “জ্বী আপু, বিক্রি হয়ে গেছে।”
তানি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
একটা হালকা কষ্ট বুকের ভেতর উঠল, তবুও মনে মনে হাসল —
“ভালোই হয়েছে। যে নিয়েছে, সে ভাগ্যবান। শাড়িটা তো এমনিই, যেকোনো গায়ে জ্বলবে আলো হয়ে।”
বৈশাখ এলো। সবাই লাল-শাদা শাড়িতে ভিড় করছে। তানি ভাবছে —
“আজ আমি একা, তবুও আমার বৈশাখে একটা হলুদ থাকবে।”
আর সত্যি, সেদিন শহরের ভিড়ে যদি কেউ দেখত, দেখত এক মেয়েকে — গায়ে এক অন্যরকম হলুদ, মুখে মৃদু হাসি, চোখে আলো।
শেষে তানির উপলব্ধি
সব গল্প সুন্দর সমাপ্তি পায় না। কিছু গল্প শুধু থেকে যায় মনে, একটু অপূর্ণতা হয়ে।
তানি বুঝেছে — ভালোবাসা মানে অধিকার না, বরং অনুভব।
যাকে চাওয়া হয়, সে যদি না-ও মেলে, তার মানে এই নয় যে ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়।
শাড়িটা হয়তো তানির হয়নি, কিন্তু সেই হলুদের রঙ আজও ওর চোখে ভাসে।
আর সেই রঙেই হয়তো তানি সবচেয়ে বেশি সুন্দর — কারণ ভালোবাসার রঙ কখনো ম্লান হয় না।