শাড়ি: ঐতিহ্য, ইতিহাস ও পরিধান শৈলী
শাড়ি হল বাংলাদেশ, ভারতসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের ঐতিহ্যবাহী ও নিত্যনৈমিত্তিক পরিধেয় বস্ত্র। এটি লম্বা ও সেলাইবিহীন কাপড় দিয়ে তৈরি হয়, যা সাধারণত ১৮ থেকে ২১ ফুট (৫.৫–৬.৪ মিটার) দীর্ঘ এবং ৬০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার (২–৪ ফুট) চওড়া। শাড়ি পরার সবচেয়ে পরিচিত পদ্ধতি হলো কোমরে প্যাঁচিয়ে একটি প্রান্ত কাঁধের উপর দিয়ে ঝুলানো, যাকে আঁচল বলা হয়। শাড়ির নিচে পেটিকোট বা সায়া পরা হয়, আর উপরের অংশে ব্লাউজ (ভারতে ছোলি) পরিধান করা হয়।
বাংলার ইতিহাসে শাড়ি শুধু পোশাক নয়, বরং সংস্কৃতি ও নারী সৌন্দর্যের প্রতীক। কালের বিবর্তনে শাড়ির পাড়, বুনন এবং পরিধান পদ্ধতি বদলেছে। বিশেষ অনুষ্ঠান, বিবাহ ও উৎসবে শাড়ি এখনো নারীদের প্রিয় পোশাক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নারী সেনাদের শাড়ি পরার বিশেষ নিয়মও এর বহুমাত্রিক প্রয়োগের প্রমাণ দেয়।
শাড়ির ব্যুৎপত্তি ও ইতিহাস
শাড়ি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ শাটী (śāṭī) থেকে, যার অর্থ ‘কাপড়ের টুকরা’। প্রাচীনকালে নারীদের ঊর্ধাঙ্গের পোশাকের জন্য স্তনপট্ট ব্যবহৃত হত, যা থেকে আধুনিক ব্লাউজ বা ছোলির উদ্ভব। পেটিকোটকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন নামে ডাকা হয়—মারাঠিতে পার্কার, তামিলে উলপাওয়াদাই এবং বাংলায় সায়া।
শাড়ির উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব সিন্ধু সভ্যতার সময় পর্যন্ত ধরা যায়। তুলা ও রেশমের উৎপাদন শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫ম সহস্রাব্দে। প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে নারীদের শাড়ি বা ‘সাত্তিক’ পরিধানের উল্লেখ আছে। প্রাচীন কালের শাড়ি তিন টুকরো কাপড়ে তৈরি হতো—নিচের অংশ, কাঁধ বা মাথার উপর ঢাকার অংশ (উত্তরীয়), এবং স্তনপট্ট।
প্রাচীন তামিল কাব্যে, ব্রজ-মথুরা ভাস্কর্য এবং ধুতি সদৃশ অন্ত্রিয় পরিধানশৈলীতে শাড়ির উদাহরণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে কেরালার মুন্ডুম ন্যারিয়াথুম এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শৈলী তৈরি হয়। শাড়ি শৈলীর বিবর্তন ঘটেছে—আধুনিক ব্লাউজ এবং পেটিকোটের সমন্বয়ে আরামদায়ক এবং ব্যবহারিক রূপ পেয়েছে।
জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর অবদান
১৮৫৯ সালে যশোরে জন্মগ্রহণকারী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বাংলায় শাড়ি পরার পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। তার আগে শাড়ি ঢেকে দেওয়া হতো, নীচে ব্লাউজ বা পেটিকোট থাকতো না। তিনি ব্লাউজ এবং পেটিকোটসহ নতুন শৈলী প্রবর্তন করেন, যা আরামদায়ক, ব্যবহারিক এবং আধুনিক মনে হত। এই নতুন শৈলী পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়।
শাড়ি পরার শৈলী
শাড়ি পরার প্রায় ৮০টিরও বেশি পদ্ধতি আছে। সবচেয়ে প্রচলিত হলো কোমরে জড়ানো ও আঁচল কাঁধের উপর দিয়ে ঝুলানো। তবে বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন শৈলী দেখা যায়:
- বাঙালি/ওড়িয়া শৈলী: ভাঁজ ছাড়া কোমরের চারপাশে প্যাঁচানো, আঁচল বাঁম কাঁধের উপর দিয়ে ঝুলানো।
- নিভি শৈলী (অন্ধ্রপ্রদেশ/গুজরাত): দুই পায়ের মাঝ দিয়ে শাড়ি পেছনে বেঁধে রাখা।
- মহারাষ্ট্রি শৈলী: শাড়ির মাঝখান পেছনে রেখে, দুই প্রান্ত ধুতির মতো পা জড়িয়ে, প্রান্ত কাঁধে ঝুলানো।
- মালায়ালি শৈলী (কেরালা): দুই অংশের মুন্ডুম ন্যারিয়াথুম, স্বর্ণ বা রঙিন ফিতে দ্বারা আলংকৃত।
- মণিপুরি, আসামি, খাসি ও অন্যান্য আঞ্চলিক শৈলী: স্থানীয় ঐতিহ্য ও প্রথা অনুযায়ী অনন্য ভাঁজ এবং আঁচল ব্যবহৃত হয়।
শাড়ি শুধুই পোশাক নয়, এটি নারীদের সৌন্দর্য, সংস্কৃতি ও আত্মপ্রকাশের অংশ। আঞ্চলিক বৈচিত্র্য শাড়ির প্রতি মানুষের গভীর আবেগ এবং ভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপটকে প্রতিফলিত করে।
শাড়ি হল বাংলা ও ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রাণ, যা কালের বিবর্তনেও নারীদের দৈনন্দিন জীবন ও বিশেষ অনুষ্ঠানে সৌন্দর্য এবং আড়ম্বরের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। ইতিহাস, শৈলী এবং আঞ্চলিক বৈচিত্র্য একত্রে এই পোশাককে যুগে যুগে সমৃদ্ধ করেছে।